খাওয়ার লবণে ফলিক অ্যাসিড মেশানোর প্রয়োজনীয়তা এবং এর উপকারিতা নিয়ে সাম্প্রতিক গবেষণাগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। ফলিক অ্যাসিড, যা ভিটামিন বি৯ নামেও পরিচিত, আমাদের শরীরের জন্য অপরিহার্য একটি পুষ্টি উপাদান। এটি বিশেষত গর্ভবতী নারীদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি শিশুর সঠিক বৃদ্ধিতে সাহায্য করে এবং বিভিন্ন জন্মগত ত্রুটি প্রতিরোধে সহায়তা করে।
গবেষণার ফলাফলগুলো দেখিয়েছে যে, খাওয়ার লবণে ফলিক অ্যাসিড মেশালে এটি সহজেই মানুষের দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাসে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যেখানে পুষ্টির অভাব একটি সাধারণ সমস্যা, সেখানে এই ধরনের পদক্ষেপ খুবই কার্যকর হতে পারে। ফলিক অ্যাসিডের অভাবে শিশুরা নিউরাল টিউব ডিফেক্টস (এনটিডি) নামক জন্মগত ত্রুটিতে আক্রান্ত হতে পারে, যা মস্তিষ্ক এবং মেরুদন্ডের বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে।
এই প্রয়োজনীয়তা এবং উপকারিতা বিবেচনা করে, বিভিন্ন দেশের সরকার এবং স্বাস্থ্য সংস্থাগুলো 🔎︎ ফলিক অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাওয়ার লবণ প্রচলনের উদ্যোগ নিয়েছে। গবেষণার সংক্ষিপ্ত পরিচয়ে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ফলিক অ্যাসিড মেশানো লবণ ব্যবহারের মাধ্যমে শিশুর জন্মগত ত্রুটি কমানোর সম্ভাবনা অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়। এই পদক্ষেপটি সহজ, সস্তা এবং কার্যকর একটি উপায় হতে পারে।
ফলিক অ্যাসিড কী?
ফলিক অ্যাসিড, যা ভিটামিন বি৯ নামেও পরিচিত, একটি গুরুত্বপূর্ণ জলীয় দ্রবণীয় ভিটামিন যা শরীরের সঠিক কার্যকারিতার জন্য অপরিহার্য। এটি ডিএনএ এবং আরএনএ সংশ্লেষণ, কোষ বিভাজন, এবং কোষ বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফলিক অ্যাসিডের অভাব শরীরের বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষ করে নারীদের গর্ভাবস্থার সময়।
ফলিক অ্যাসিডের রসায়নিক উপাদান হলো সি১৯এইচ১৯এন৭ও৬। এই ভিটামিনটি প্রায়শই খাবারের সঙ্গে যুক্ত হয় যাতে জনসাধারণ সহজেই এটি পেতে পারে। প্রকৃতিতে ফলিক অ্যাসিড বিভিন্ন খাদ্যে পাওয়া যায়, যেমন শাকসবজি, ডাল, বাদাম, এবং লিভার। এছাড়াও, গর্ভবতী নারীদের জন্য ফলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্ট খুবই প্রয়োজনীয়, কারণ এটি শিশুর সঠিক গঠন এবং স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে সহায়ক।
ফলিক অ্যাসিডের কার্যকারিতা সম্পর্কে বলতে গেলে, এটি প্রধানত মস্তিষ্ক এবং মেরুদণ্ডের সঠিক বিকাশে সহায়ক হয়। ফলিক অ্যাসিডের অভাবের কারণে নবজাতক শিশুদের মধ্যে নিউরাল টিউব ডিফেক্টস নামে পরিচিত শারীরিক ত্রুটি দেখা দিতে পারে। এই ধরনের ত্রুটি সাধারণভাবে মেরুদণ্ডের ত্রুটি বা মস্তিষ্কের ত্রুটি হিসেবে প্রকাশ পায়। তাই গর্ভবতী নারীদের ফলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ফলিক অ্যাসিডের খাদ্য উৎস সম্পর্কে বলতে গেলে, শাকসবজি যেমন পালং শাক, ব্রোকলি, এবং অ্যাসপারাগাসে প্রচুর পরিমাণে ফলিক অ্যাসিড পাওয়া যায়। ডালে, বিশেষ করে মসুর ডালে, এবং বাদামে ফলিক অ্যাসিডের পরিমাণ বেশি থাকে। গরুর লিভার এবং মুরগির লিভারও ফলিক অ্যাসিডের ভালো উৎস। এছাড়াও, অনেক বাণিজ্যিক খাদ্য প্রস্তুতকারক তাদের পণ্যে ফলিক অ্যাসিড যোগ করে যাতে মানুষের খাদ্যাভ্যাসে এর অভাব না হয়।
শিশুর জন্মগত ত্রুটি এবং ফলিক অ্যাসিডের ভূমিকা
শিশুর জন্মগত ত্রুটি এক ধরনের শারীরিক বা মানসিক বিকাশের ব্যাঘাত যা শিশুর জন্মের সময় থেকেই বিদ্যমান থাকে। এই ত্রুটিগুলি শরীরের বিভিন্ন অংশে, যেমন হার্ট, মস্তিষ্ক, বা স্পাইনাল কর্ডে থাকতে পারে। জন্মগত ত্রুটির কারণগুলির মধ্যে জেনেটিক ফ্যাক্টর, পরিবেশগত কারণ এবং মায়ের গর্ভাবস্থায় পুষ্টির অভাব উল্লেখযোগ্য। এগুলির মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান হলো ফলিক অ্যাসিড।
ফলিক অ্যাসিড একটি প্রয়োজনীয় ভিটামিন যা ডিএনএ সংশ্লেষণ এবং কোষের বিভাজনের জন্য অপরিহার্য। গর্ভাবস্থার প্রথম কয়েক সপ্তাহে ফলিক অ্যাসিডের পর্যাপ্ত মাত্রা শরীরে না থাকলে নিউরাল টিউব ডিফেক্ট (এনটিডি) এর মত গুরুতর জন্মগত ত্রুটি হতে পারে। এনটিডি একটি গুরুতর অবস্থা, যেখানে শিশুর মস্তিষ্ক এবং স্পাইনাল কর্ড পুরোপুরি গঠিত হয় না।
গবেষণায় দেখা গেছে যে গর্ভাবস্থার পূর্বে এবং গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে যথেষ্ট পরিমাণ ফলিক অ্যাসিড গ্রহণ করলে এই ধরনের জন্মগত ত্রুটির ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো যায়। ফলিক অ্যাসিডের পর্যাপ্ত মাত্রা নিশ্চিত করতে খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনা যায়, যেমন সবুজ শাকসবজি, ডাল, এবং সাইট্রাস ফল বেশি খাওয়া। তবে শুধুমাত্র খাবারের মাধ্যমে পর্যাপ্ত ফলিক অ্যাসিড গ্রহণ সবসময় সম্ভব হয় না, এজন্য ফলিক অ্যাসিড সম্পূরক গ্রহণ করা জরুরি।
সম্প্রতি গবেষণায় প্রস্তাব করা হয়েছে যে খাওয়ার লবণে ফলিক অ্যাসিড মেশানোর মাধ্যমে জনস্বাস্থ্যের উন্নতি করা যেতে পারে। এই পদ্ধতির মাধ্যমে সাধারণ জনগণের মধ্যে ফলিক অ্যাসিডের পর্যাপ্ততা নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এটি বিশেষত গর্ভবতী মহিলাদের জন্য উপকারী, যারা প্রায়ই খাদ্যাভ্যাসে পুষ্টির ঘাটতি পূরণ করতে ব্যর্থ হন। ফলিক অ্যাসিডের সঠিক মাত্রা নিশ্চিত করে শিশুর জন্মগত ত্রুটির ঝুঁকি কমানো সম্ভব, যা ভবিষ্যতের জন্য একটি সুস্থ সমাজ গঠনে সহায়ক হবে।
গবেষণার পদ্ধতি
গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে একটি সুপরিকল্পিত এবং সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে, যাতে ফলিক অ্যাসিডের কার্যকারিতা সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা যায়। গবেষণায় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ছিল উল্লেখযোগ্য, যা ফলাফলকে আরো নির্ভরযোগ্য করে তোলে। মোট ৫,০০০ জন অংশগ্রহণকারী এই গবেষণায় অংশগ্রহণ করেন, যাদের মধ্যে নারী এবং পুরুষ উভয়ই ছিল। অংশগ্রহণকারীদের বয়স ১৮ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, যাতে বিভিন্ন বয়সের প্রজননক্ষম ব্যক্তিদের ওপর ফলিক অ্যাসিডের প্রভাব পর্যবেক্ষণ করা যায়।
গবেষণাটি মোট ৩ বছর ধরে পরিচালিত হয়, যা দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব মূল্যায়নের জন্য যথেষ্ট সময়। প্রথমত, অংশগ্রহণকারীদের প্রাথমিক শারীরিক অবস্থার তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এরপর তাদের দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাসে নির্দিষ্ট মাত্রায় ফলিক অ্যাসিড মেশানো হয়। প্রতি ছয় মাস অন্তর অংশগ্রহণকারীদের শারীরিক পরীক্ষা এবং রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে ফলিক অ্যাসিডের প্রভাব মূল্যায়ন করা হয়।
গবেষণার পদ্ধতিতে পর্যবেক্ষণমূলক এবং পরীক্ষামূলক উভয় প্রকারের পন্থা অনুসরণ করা হয়েছে। পর্যবেক্ষণমূলক পদ্ধতিতে অংশগ্রহণকারীদের দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাস এবং শারীরিক অবস্থার পরিবর্তনগুলি রেকর্ড করা হয়েছে। পরীক্ষামূলক পদ্ধতিতে ফলিক অ্যাসিডের সুনির্দিষ্ট মাত্রা এবং এর প্রভাব পরিমাপ করা হয়েছে। এতে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে কেউ ফলিক অ্যাসিডযুক্ত লবণ গ্রহণ করেছেন, আবার কেউ সাধারণ লবণ গ্রহণ করেছেন, যাতে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা যায়।
গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে যে ফলিক অ্যাসিডযুক্ত লবণ গ্রহণকারী অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে জন্মগত ত্রুটির হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। এই পদ্ধতিগত গবেষণা ফলিক অ্যাসিডের কার্যকারিতা এবং প্রয়োজনীয়তার ওপর একটি সুদৃঢ় প্রমাণ উপস্থাপন করেছে, যা ভবিষ্যতে জনস্বাস্থ্য নীতিতে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
অপর একটি গবেষণায় ইউনিভার্সিটি অফ সেন্ট্রাল ফ্লোরিডা ও এমরি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞসহ আন্তর্জাতিক গবেষকদের একটি দল এই গবেষণা পরিচালনা করেন। দক্ষিণ ভারতে , যেখানে এনটিডি-এর প্রকোপ বেশি, সেখানকার চারটি গ্রামে এই গবেষণা চালানো হয়। ২০২২ সালে চার মাস ধরে ১৮-৪৫ বছর বয়সী ৮৩ জন অ-গর্ভবতী মহিলা তাদের নিত্যদিনের খাদ্যতালিকায় ফলিক অ্যাসিড সমৃদ্ধ আয়োডিনযুক্ত নুন গ্রহণ করেন। ফলাফল ছিল চমকপ্রদ! তাদের রক্তে ফোলেটের মাত্রা প্রায় ৩.৭ গুণ বেড়ে যায়, যা স্পাইনা বিফিডা ও অ্যানেন্সেফালি প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজনীয় মাত্রায় পৌঁছে।
গবেষণার ফলাফল
গবেষণার ফলাফল থেকে জানা যায় যে, খাওয়ার লবণে ফলিক অ্যাসিড মেশানোর মাধ্যমে শিশুর জন্মগত ত্রুটি রোধ করা সম্ভব। গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ফলিক অ্যাসিডের উপস্থিতি বিশেষ করে নিউরাল টিউব ডিফেক্ট (এনটিডি) এর ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
গবেষণায় অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন দেশের তথ্য থেকে দেখা যায় যে, যেখানে ফলিক অ্যাসিড সম্পন্ন লবণ ব্যবহার করা হয়, সেখানে এনটিডি এর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফলিক অ্যাসিড সম্পন্ন লবণ ব্যবহারের পর এনটিডি এর হার ৩৫% কমে গেছে।
অন্যদিকে, গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, ফলিক অ্যাসিডের অভাবে গর্ভবতী নারীদের মধ্যে এনটিডি এর ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। উদাহরণস্বরূপ,ভারত বা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে যেখানে ফলিক অ্যাসিডের সহজলভ্যতা কম, সেখানে এনটিডি এর হার তুলনামূলকভাবে বেশি।
গবেষণার প্রমাণ হিসেবে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, ফলিক অ্যাসিড সম্পন্ন লবণ ব্যবহারের মাধ্যমে শিশুর মস্তিষ্ক এবং মেরুদণ্ড বিকাশে সহায়ক উপাদান সরবরাহ করা যায়। এটি গর্ভাবস্থায় নারীদের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
গবেষণার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, ফলিক অ্যাসিড সম্পন্ন লবণ ব্যবহারের মাধ্যমে শিশুর জন্মগত ত্রুটি রোধ করার পাশাপাশি গর্ভবতী নারীদের স্বাস্থ্যও নিশ্চিত করা যায়। ফলিক অ্যাসিডের উপস্থিতি নারীদের শরীরে রক্তাল্পতা রোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
গবেষণার ফলাফল থেকে স্পষ্ট হয়েছে যে, খাওয়ার লবণে ফলিক অ্যাসিড মেশানো একটি কার্যকর পদ্ধতি হতে পারে শিশুর জন্মগত ত্রুটি রোধে। এই পদ্ধতির মাধ্যমে না শুধু শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষিত করা যায়, পাশাপাশি গর্ভবতী নারীদের স্বাস্থ্যও উন্নত করা সম্ভব।
ফলিক অ্যাসিড মেশানো লবণের ব্যবহার নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা এবং গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য সামাজিক গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। সাধারণ মানুষ এই উদ্যোগকে কতটা গ্রহণ করছে এবং এর সম্পর্কে তাদের জানাশোনা কতটা, তা নির্ধারণ করতে এই ধরনের গবেষণা অত্যন্ত জরুরি।
যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশগুলিতে শস্যজাত খাবারে ফলিক অ্যাসিড যোগ করা বাধ্যতামূলক করার ফলে এনটিডি’র হার অনেক কমেছে। কিন্তু বিশ্বের অনেক দেশে, বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলিতে, এখনও এই ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এর কারণ হিসেবে অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, অর্থনৈতিক সমস্যা, এবং জনসচেতনতার অভাবকে দায়ী করা যায়।
এই গবেষণার ফলাফল থেকে বোঝা যায়, খাদ্য লবণে ফলিক অ্যাসিড যোগ করার মাধ্যমে সহজ এবং সাশ্রয়ী উপায়ে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। লবণ সারা বিশ্বেই সহজলভ্য এবং সকলের খাদ্যতালিকার একটি অপরিহার্য উপাদান। তাই লবণের মাধ্যমে ফলিক অ্যাসিড সরবরাহ করা হলে তা সহজেই সকলের কাছে পৌঁছানো সম্ভব।